৭ মার্চ। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরেও লেখা অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ দিন। ২৫ মার্চ কালো রাতে পাক-বাহিনীর হাতে গ্রেফতারের আগে বঙ্গবন্ধু আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেও মূলত ৭ মার্চের ভাষণেই তিনি স্বাধীনতার বিষয়টি অনিবার্য করে তুলেছিলেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী হিসেবে বলব, সূক্ষ্ম আর গভীর রাজনৈতিক জ্ঞান সম্পন্ন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেদিনই তার ভাষণে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের ডাক দিয়ে বলেছিলেন- ‘তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু- আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ কওে দেবে’ কিংবা ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এসব উক্তিগুলোই তার জ্বলন্ত প্রমাণ। এসব রেকর্ড আজও বাংলার পথে প্রান্তরে বাজে। সেই বজ্রকণ্ঠ আজও মানুষ তন্ময় হয়ে শোনেন। এতকিছুর পরও স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে বিতর্ক হয়, বিতর্ক তোলেন। লাখো বাঙালি রক্তে রাঙানো এ স্বাধীন দেশে এই মনে হয় সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে বিতর্ক তোলা মানেই বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র জন্মের ইতিহাসের সঙ্গে বেঈমানী করা। বেঈমানদের এদেশে থাকার কোনো নৈতিক অধিকার নেই।
এ ভাষণ প্রথম শুনেছিলাম দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র থাকাবস্থায়, সময়টা ঠিক মনে নেই। তবে দিনটা মনে করতে পারি, গ্রামের বাজারে কিছু অগ্রজের উদ্যাগে ঐতিহাসিক ৭ মার্চ উপলক্ষে ভাষণটি বাজানো হয়েছিল। সেই অতটুকু বয়সে আমি খুব যে রাজনৈতিক ভাষণটি বুঝতে পেরেছিলাম তা বলছি না, তবে এটুকু এখনও স্পষ্ট মনে আছে- প্রথমবার যখন শুনেছিলাম, সেদিনের সেই ভাষণটি আমার কর্ণকুহরে ঢুকে মর্মে আঘাত করে। শরীরের সমস্ত পেশিতে একটা গভীর টান অনুভব করি। আচমকা আমার লোমকুপগুলো জেগে যায়। আমি ক্ষুব্ধ হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকি। আমার চোখগুলো বড় বড় হয়ে যায়। তখন মনে হচ্ছিল আমার শরীরের রক্তগুলো উজানে চলতে শুরু করেছিল। বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠ আমার শিশু মনকেও উত্তাল করে তুললো। আমি অবাক হয়ে শুনতে লাগলাম বঙ্গপিতার অলিখিত রাজনৈতিক কবিতা, ‘আমি, আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না। আমরা এদেশের মানুষের অধিকার চাই। আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে দেবার চাই, আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্টকাচারী, আদালত-ফৌজদারী, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে।’ আমার শোনা ভাষণের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম স্যারের অভিজ্ঞতার কিছুটা মিল রয়েছে। তিনি এক বিদেশি সাংবাদিকের দো-ভাষী হিসেবে সেদিন রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি ভাষণটি শোনার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে লিখেছেন, ‘আমি প্রথম তিন-চার লাইন দ্রুত অনুবাদ করলাম, কিন্তু সাংবাদিক আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন- আমি বরং ভাষণটা শুনি, তুমি যদি পার, মনে রাখার চেষ্টা কর, পরে আমাকে অনুবাদ করে শোনাবে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পুরোটা সময় সেই সাংবাদিক একাগ্রতা নিয়ে মাঠে ঠায় বসেছিলেন। তার মুখ দেখে মনে হচ্ছিল তিনি প্রতিটি বাক্য বুঝেছেন, যেন বঙ্গবন্ধু বাংলাতে নয়, ইংরেজিতেই ভাষণ দিচ্ছেন।’ এখন যখন আমি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি নির্মলেন্দু গুণের লেখা ‘স্বাধীনতা-এই শব্দটি কিভাবে আমাদের হলো’ এই কবিতাটা পড়ি তখন আমার চোখের সামনে ভাসতে থাকে অবিরাম দৃশ্যপটের মত- ‘লক্ষ লক্ষ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে/ ভোর থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে, কখন আসবে কবি? ... শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে, রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে/ অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন/ তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল, হৃদয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার সকল দুয়ার খোলা/ কে রোধে তাহার বজ্রকন্ঠ বাণী? গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি/ এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
ভাষণে শব্দের ব্যবহার কিংবা শব্দের শৈল্পিক খেলার জাদু এসব নিয়ে আমার নতুন করে কিছু বলার নেই। আমি আজ শুধু আমার অনুভূতির কথা বলতে চাই। কথা সাহিত্যিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু কথা বলছিলেন না, তিনি যেন বাঙালি জাতির সংগ্রামী ইতিহাসের একটা মুখবন্ধ লিখছিলেন। রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত থেকে ভাষণটি শুনে একজন বিদেশি সাংবাদিক বলেছিলেন- নিশ্চয়ই জাদু। ইট ওয়াজ সিম্পলি ম্যাজিক্যাল। বিশ্বের সেরা ১’শ ভাষণের তালিকায় স্থান পেয়েছে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটি। স্বাধীন সার্বভৌম জাতির কাছে এটিও কম গর্বের নয়।’ গতবছর(২০১৫) বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বঙ্গবন্ধু তনয়া দেশরত্ন শেখ হাসিনা ঐতিহাসিক ভাষণটি সম্পর্কে তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে বলেন, ‘এ ভাষণটি যখন আমার বাবা দিতে যাবেন, তখন অনেক লেখা, অনেক পরামর্শ নিয়ে সবাই হাজির। যখনই বঙ্গবন্ধু কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দিতে যেতেন, তখন আমার মা একটা কাজ করতেন- সকলের কাছ থেকে বঙ্গবন্ধুকে কিছুক্ষণের জন্য আড়াল করে দিতেন। মা আব্বাকে শোবার ঘরে নিয়ে গেলেন, আমিও সেখানে। বললেন, তুমি এখানে অন্তত ১৫টা মিনিট চুপ করে শুয়ে থাক। আমি আব্বার মাথার কাছে বসে আস্তে আস্তে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। মা পাশে মোড়াটা টেনে নিয়ে বসলেন। বললেন- আমি একটা কথা বলতে চাই। আজকে, তোমার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা দিন। লাখো মানুষ তোমার সামনে। এই মানুষের ভাগ্য তোমার হাতে। অনেকে অনেক পরামর্শ দেবে, অনেকে অনেক কথা বলবে। কিন্তু, তোমার মন যে কথা বলবে, তুমি ঠিক সেই কথাটাই তোমার ভাষণে বলবে। অন্য কোনো কথা বলবে না। আর, তুমি যা বলবে- বাঙালির জন্য সেটাই সঠিক হবে। বাস্তবে সেটাই হয়েছিল।’ ভাষণ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী আরো বলেছেন, ‘বাঙালি জাতির জন্য এই ভাষণ নতুনভাবে বেঁচে থাকার প্রেরণা দেবে, সাহস দেবে, যে কোনো ধরনের বাধা আসুক না কেন- তা অতিক্রম করে বিশ্ব দরবারে বাঙালি জাতিকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করবার শক্তি ও সাহস জোগাবে। আমাদের সংগ্রাম এখনও তো শেষ হয়নি। এখনও সেই জঙ্গিবাদী কর্মকান্ড, মানুষ পুড়িয়ে মারা, মানুষকে হত্যা করা, মানুষের ওপর এখনও নানাভাবে জুলুম চলছে। আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। আমাদের প্রেরণা দেবেন জাতির পিতা। এই ভাষণের প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য মনে হয় নতুনভাবে প্রেরণা দেয়, নতুনভাবে মানুষকে উজ্জীবিত করে।’ প্রত্যেক মানুষের জীবনে কখনো কখনো এমন কিছু মুহুর্ত আসে যখন তাকে ক্ষনিকের জন্য হলেও থমকে দাঁড়াতে হয়। সে সময় মানুষ অনেকটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। আমার জীবনেও এমন বহু সময় এসেছে, আমি থমকে না দাঁড়িয়ে অনুপ্রেরণা নিয়েছি, আমার অনুপ্রেরণার উৎস বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটি। পিতা মুজিবের ভাষণটি এখনো প্রত্যকদিন নতুনভাবে আমার চলার পথে অবিরাম অনুপ্রেরণা দিয়ে চলেছে। ৪৫ বছরের পুরনো ভাষণটি আমি যতবারই শুনি ততবারই আমার কাছে নতুন করে ধরা দেয়, প্রতিবারই সেই প্রথমবার শোনার অনুভূতিই পাই। ৭ই মার্চ বাঙালির জীবনে অক্ষয় হয়ে থাকুক । জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু লেখক : সাধারণ সম্পাদক , বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদ
রাজনীতি
[রাজনীতি][twocolumns]
আন্তর্জাতিক
[আন্তর্জাতিক][bleft]
বিজ্ঞান-প্রযুক্তি
[বিজ্ঞান-প্রযুক্তি][bsummary]
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
social counter
[socialcounter]
[facebook][#][215K]
[twitter][#][115K]
[google-plus][#][200K]
[instagram][#][152,500]
Popular Posts
recent posts
recentposts
popular
-
অনলাইন ডেস্ক: ডিম হচ্ছে এমন একটি খাবার যা ভীষণ সহজে রান্না করা যায়, অনেক রকম রেসিপিতে রান্না করা যায়, আবার ছোট-বড় সকলেই খেতে ভালোবাসেন। ...
-
রসমালাই খাবারটির নাম শুনলেই জিভে পানি চলে আসে। যারা মিষ্টি খেতে পছন্দ করেন না তারাও রসমালাই খেতে পছন্দ করেন। মজাদার এই মিষ্টিটি সাধারণত ছ...
-
শীতের অন্যতম একটি সবজি হল বাঁধাকপি। শীতকালে প্রায় সব বাসায় বাঁধাকপি ভাজি করা হয়। এমনকি বাঁধাকপি দিয়ে তরকারিও রান্না করা হয়ে থাকে! বাঁধাকপ...
-
রেস্তরাঁ স্টাইলে রান্না করা শীতের সবজি সবজি যারা খেতে পছন্দ করেন, তাদের জন্য শীতকাল খুব প্রিয় একটি ঋতু। বাজারে গেলে পাওয়া যায় নানা রকম ...
-
যা লাগবে মুরগি স্কিনসহ আস্ত (১ কেজি পরিমাণ ) ১ টি গোলমরিচ ফাঁকি ১ টেবল চামচ লবণ ২ চা চামচ পাপরিকা পাউডার ২ চা চামচ ( পাপরিকা না পেলে কাশ...
-
আপনার নিজের হাতে রান্না করা খাবারের খুব সুন্দর একটি ছবিসহ রেসিপিটি বাংলায় লিখে পাঠিয়ে দিন আমাদের ফেসবুক পেজের ইনবক্সে। আপনার রেসিপিটি য...
-
অনলাইন ডেস্ক: আমরা প্রতিনিয়ত যেসকল খাবার খাচ্ছি তা সরাসরি আমাদের শরীরে প্রভাব ফেলছে। শুধু শরীর নয় এটি আমাদের ত্বকেও প্রত্যক্ষভাবে প্রভাব ...
-
রাজীবপুর (কুড়িগ্রাম) : এই বিশ্ব সংসারে অনেক ঘটনা ঘটে যার কোনো ব্যাখ্যা নেই। তেমনি একটি ঘটনা ঘটেছে ব্রহ্মপুত্র নদ বিচ্ছিন্ন দুর্গম দইখাওয়া...
-
শীতের এই মৌসুমে গরম গরম কাবাব আর নানা কিন্তু সন্ধ্যে হলেই বেশ জমে। কাবাব খেতে বাইরে যাওয়া কেন, ঘরেই তৈরি করে নিন না মজাদার রেশমি কাবাব। চ...
No comments: